ADS

প্রবাসীর জীবনের বাস্তবতা _ মুছা গাজীর লেখা


প্রবাসীর জীবনের বাস্তবতা 


কেনো আমি বিবাহ বরে বউ দেশে রেখে মা বাবা ভাইবোন সকল পরিবার পরিজন দেশে রেখে বিদেশ আসলাম! 

না হতে পারলাম মা বাবার ভালো সন্তান, না হতে পারলাম বউয়ের ভালো স্বামী। না হতে পারলাম ভাইবোনের ভালো ভাই , না হতে পারলাম সমাজ সেবক। না হতে পারলাম সন্তানের বাবা , না হতে পারলাম কোটিপতি। না হতে পারলাম সফল কোনো ব্যাবসায়ী। না হতে পারলাম সফল কোনো প্রবাসী, কি দোষ ছিলো আমার ? 


আমি কি পৃথিবীতে খুব ই জঘন্য একজন মানুষ!  যখন দেশে ছিলাম তখনতো সবই ঠিক ছিলো। আমার জীবনে তখন তো আমি সবার নয়নের মনি ছিলাম সবাই খুব আদর, স্নেহ , সন্মান ,সবই পেতাম। কাকা ,কাকী , ফুফু ,ফুপি, খালা , খালু , মামা , মামী ,নানা, নানী , দাদা , দাদী গ্রামের প্রতিবেশী সহ সকল প্রান্তে আমার কতো কদর কতো যে ভালোবাসা ছিলো, আমার জীবনে সেটা আমি বলে বোঝাতে পারবোনা। 


আমার জীবনের যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি সেটা হলো প্রবাস জীবন , কি পেলাম এ জীবনে ? শুধুই যে হারালাম গ্রামের কোনো লোক মারা গেলে জানাযায় ও শরিক হতে পারিনা এটা আমার সবচাইতে বেশি কষ্ট লাগে যখন শুনি ওমক , তমক মারা গেছে তখন শুধু কল্পনার মাঝে তাকে শেষ দেখা দেখি আর দোয়া করি এর বেশি আর কি ই বা আমি করতে পারি ? 


জীবনের বয়স কমছে আস্তে আস্তে কিন্ত সুখের ঠিকানা আজও আমি পেলাম না। আর আমি জানি যে আর আমি সুখ শান্তি পাবো না তাই সুখের আশা ছেড়েই দিয়েছি। এখন শুধু প্রহর গুনি যে কবে এই জীবন থেকে ছুটি পাবো!!  আমি একটু ঘুমাতে চাই যে ঘুম থেকে মানুষ আর জেগে ওঠে না। কারন এখন তো আর আগের মতো ঘুমাতে পারিনা সময় কই রাত ১১/১২ টায় ঘুমায় আর ঘুমের মাঝে মধ্য জেগে উঠি এই মনে হয় গাড়ী মিস করলাম কাজে যাইতে হবে তা না হলে বসের ইংরেজী  বকুনি। 


 ঐ দিকে আবার বেতন কাটা যাবে পুরা বেতন না পেলেতো আবার  ঐ দিক থেকে বাংলাই গালাগাল আছে সেই ভয়ে ভোর ৬:০০ টায় উঠি কাজে যাই। ঐ দিকে আবার আগের মতো খেতে পারিনা কারন এখানেতো মায়ের হাতের রান্না , বউয়ের হাতের রান্না করা কিছু পাইনা তাই খাইতে ও মন চায়না। জোর করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে কোনো মতে একটু খাই , যা পাই তাই ক্যাটারিং খাবার আর কতো খাওয়া যায় একি খাবার রোজ রোজ , যাই হোক এটাই জীবন জীবনে হারাতে হারাতে সবই তো হারালাম। 

 

এমনকি মাথার চুল গুলিও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে কারন ডিউটির সময় যে হেলমেট পরে কাজ করতে হয় ১২ ঘন্টা কোনো কোনোদিন ১৮ ঘন্টা ও এক টানা কাজ করেছি ৪ বছর এক টানা যদি হেলমেট পরি তা হলে তো আমার মাথার চুল সাদা হবেই , চুল উঠে যাবেই আর তাতেই কি আমি বুড়া হয়ে গেলাম ? সে কথা ও মাঝে মাঝে শুনতে হয় আপনজনের কাছ থেকে তাতে কি আমাকে বুড়া বললেই কি আমি বুড়া হয়ে গেলাম কিন্তু এটাও আমাদের প্রবাসীদের শুনতে হয় কিন্তু কিসের জন্য টাক হলাম কিসের জন্য চুল পাকলো সেটা কেহ ভাবেনা। 


আর ভাববেইবা কেনো তাদের শুধু একটা ই ভাবনা কবে মাসের ১০ তারিখ হবে কবে ব্যাংকে টাকা ঢুকবে এই একটাই চিন্তা করে কুল পাইনা , আমি  শালা সুস্থ আছি কিনা পুরা মাস কাজ করতে পারিছিকিনা সেটা তাদের জানার দরকার নাই। তাদের শুধু টাকা টাকা আর টাকা চাই আর আমার কি চাই ?? কখন আমি স্যালারী পাবো কখন দেশে টাকাটা পাঠাবো কখন আমার পরিবার ভালো থাকবে শুধু এটাই চিন্তা ভাবনা। 


 আর কাজের কথা নাই বা বলি যে এখানে কি কি ধরনের কাজ করি আমরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকি তবে হ্যা এখানে কিন্তু শুট বুট টাই পরে অফিস করিনা তবে সেটাও মাঝে মধ্য দেশের মানুষের কাছ থেকে শোনা লাগে দেশের মানুষ ফোন করলে বলে যে তোমার অফিস কেমন চলছে বাবা ? এখন কি অফিসে ? তুমি কি ব্যাস্ত? তুমি কি খাওয়া দাওয়া করছো ? এই রকম আরো কতো কথা শুনি উত্তর ও আমরা ম্যানেজ করে দি কারন আমরা প্রবাসীরা অভিনয় ঠিক ভালো ভাবে করতে পারি৷ 

 

 প্রায় ৩৪ ডিগ্রি তাপ মাত্রা মাথার উপর রেখে আমরা বলি আমার অফিস এসি রুম মা , ঈদের দিনে কাজ করি দুপুরে খাই ক্যাটারিং ডাল আর তেলা কচু রান্না তরকারি আর বলি এইতো আমরা বিরিয়ানি দিয়ে খাচ্ছি আর আনন্দ করছি এটাই আমাদের বা আমার অভিনয়। 

 

 তা হলে একটি প্রশ্ন এতো ডিউটি করে বিদেশ করে টাকা কি করছি টাকা কই ? না আমি কোনো ফালতু টাকা নষ্ট করিনি , না আমি কোনো ক্যাসিনো খেলে টাকা নষ্ট করিনি , আজ ও আমার সিংগাপুরের প্রথম স্যালারীর $89 ডলারের সহ গতো মাসের বেতনের সকল স্যালারি  রিসিট আছে আমার কাছে সব ব্যাংক রিসিট যে টাকা আমি দেশে পাঠিয়েছি ,না আমি কোনো অবৈধভাবেও বিদেশে আসিনি আমার কাছে সব কয়টা ম্যানপাওয়ার কাড আছে। 

 

আর আমি কোনোদিন হুন্ডির মাধ্যমেও টাকা পাঠাইনি সব টাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়েছি সব রিসিট আছে , তা হলে টাকা গেলো কই এবার আজ আমি জাতির কাছে তুলে ধরবো আমার টাকার হিসাব , আমি বার বার হেরে গেছি আমার ভাগ্যের কাছে আমি পারিনি একটানা বিদেশ করতে ,প্রথম ২০১৪ সালের জুন মাসে আমি প্রথম সিংগাপুর আসি তখন লেগেছিলো এজেন্ট মানি ৩,৫০,০০০ টাকা তার ২ লক্ষ টাকা ছিলো ব্রাক থেকে নেওয়া আর বাকি ১,৫০,০০০ হাজার ছিলো ৩ জনের কাছ থেকে ধার নেওয়া একজন ১ লক্ষ , একজন ২৫,০০০ আরেকজন ২৫,০০০ সব টাকা আমি আস্তে আস্তে পরিশোধ করেছি। 


তবে ব্রাকের ২ লক্ষ টাকার জন্য গুনতে হয়েছে আমার ২,৪৭,০০০ টাকা আর অন্য ৩ জন কোনো বাড়তি টাকা নেয়নি তবে এর ভিতর একজন ২৫ এর লোক ৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলো আজ ও তা ফেরত পাইনি আর পাবো ও না , ১৭ মাস থেকে চলে যেতে হলো আমার কোমপানির কাজ না থাকার কারনে পাঠিয়ে দিলো আমাকে তবে তখনো আমি রিনি কারন বেতন পেতাম $350/450/500/600/700 ডলার যে মাসে  যেমন ওভার টাইম হতো আরকি কারন তখন নতুন আর বেসিক ছিলো $১৬ ডলার তাতে কতোইবা পাইতাম চলে গেলাম দেশে আবার চেসটা করলাম।


 অন্য কোমপানিতে ২ মাস ১৩ দিন পরে আবার ফিরলাম সিঙ্গাপুর খরচ ১,২০,০০০ টাকা তার ভিতর ৫০,০০০ ধারের  , আবার ভাগ্য শুরু করলো আমার সাথে খেলা করা ৯ মাস পরে আবার দেশে পাঠিয়ে দিলো হুন্দাই কোমপানি ফিরলাম শুন্য হাতে। 


আবার চেষ্টা এবার ভিসা ঠিক ই হলো তবে ১৪ মাস পরে ২০১৮ তে টাকা লাগবে ২ লক্ষ আবার ছুটে গেলাম ব্রাকে দিলো ও আমাকে আসলাম ফিরে আবার সেই স্বপ্নের সিংগাপুরে কাজ শুরু করলাম বলে রাখা ভালো এর ভিতর ২০১৭ তে অক্টোবর মাসে বিয়েটা ও সেরে ফেলছি যাই হোক ২০১৮ তে আবার আসলাম কাজ শুরু করি শুরুটা ভালোই ছিলো তবে বছর ঘুরতেনা ঘুরতেই আবার টিকেট রেডি তবে এবার টিকেটটা একটু আনন্দের ও বটে  কারন কোমপানি ই ছুটিতে পাঠাচ্ছে ২ মাসের জন্য গেলাম দেশে ছুটি শেষে ফিরে আসলাম ২০১৯ মার্চ মাসে শুরু করলাম কাজ ৬ মাস শেষ হতেনা হতেই লেগে গেলো ঝগড়া ম্যানেজারের সাথে সেটা আবার সেলারি নিয়ে সে তিন মাসের বেতন আটকে রেখে ভেংগে ভেংগে দিবে আর আমাদের বেতনের টাকা সে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে দেশে অট্ট লিকা বানাবে বানাইছে ও আমি নিজে জেয়ে দেখে এসেছি। 


যাইহোক সে ৩ মাসের বেতন রাখবেই সকল ওয়ার্কারদের আমি বললাম যে না আমি আপনার মতো এতো ধনী নই যে আমার ৩ মাস বেতন না নিলে চলবে আমি উনাকে বললাম যে ভাই আপনার পরিবার আছে আমার কি পরিবার নাই ? ব্যাস এইটুকুই ভুলের কারনে আমাকে তাহার ছামারী পাওয়ার ইউস করে পাঠিয়ে দিলো ফিরে গেলাম আবার দেশে আজ কাল আজকাল করতে করতে কেটে গেলে পুরা ৬ মাস। 


৬ মাস বেকার থাকা পরিবার সহ ঢাকাতে পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকাটা যে কতোটা কষ্টের সেটা আমি টের পাইছি ঐ যে আবার সিংগাপুরের নেশা মাথা থেকে নেমে জাবে জাবে ঠিক এই সময় দীর্ঘ ৬ মাস অপেক্ষা থাকার পরে আবার ভিসা তবে এবার একজন এজেন্টের সহানুভূতির কারনে টাকার অংকটা একটু কম তাকে দিয়েছিলাম আমি মাত্র ৫০ হাজার টাকা তবে সেটা ও জনের কাছ থেকে ধার এনে , আবার পাড়ি জমালাম ২০২০ সালের ৮ ই ফেব্রুয়ারিতে ১৬ তারিখ থেকে কাজ শুরু করলাম চলছিলো ভালই তারপর চলে আসলো করোনা নামক এক অভিশাপের লিলা খেলা জার জন্য সারা দুনিয়া বয়ে বেড়াচ্ছে।


 এখোনো দুর্বিষহ জীবন আমিও তার একজন শেষ হতে লাগলো ২০২০ সালের মাস গুলি সেই সাথে শেষ হয়েছে আমার পারমিটের মেয়াদ কারন আমার পাসপোর্টের মেয়াদ কম থাকাতে পারমিট ও খুব অল্প সময়ের হয় ৯ মাসের  পাসপোর্ট রিনিউ করতে দিয়েছিলাম পারমিটের মেয়াদ ৩ মাস থাকতে তাতে হবে কি আমার দেশের বাবুদের যে কাজের দুর্গতি পুরা ৩ টা মাস লাগিয়ে দিলো পাসপোর্ট রিনিউ করতে ততক্ষনে আমার বারোটা বেজে গেছে পারমিট শেষ হওয়ার ২ দিন আগে এপ্লায় করলো কোম্পানি কিন্তু কাজে আসলো না।

 

 আমার আবার হেরে গেলাম ভাগ্যর কাছে তবে মনটাকে মানাতে পারছিনা শেষ চেষ্টাটা করে দেখি অন্য কোমপানিতে ভিসা হলে এক হাজার ডলার দিতে হবে যা বাংলা টাকায় ৬০,০০০ টাকা রাজি হলাম ভিসা ও হলো নতুন বছর ২০২১ নতুন কোমপানি নতুন স্বপ্ন বিশ্বাস আর সংকল্প নিয়ে শুরু করলাম এক উদ্দিপনার জীবন। 

 

আর ঠিক এই মুহুর্তে আমার পাশে না দাঁড়িয়ে কেওবা চলে যেতে চাই আমাকে মাঝ নদীতে একা ফেলে তবুও আমি কাঁদিনা  কারন আমার চোখে যে আর পানি নাই কি লাভ কেঁদে ? তাইতো বলি কেনো বিদেশে আসলাম , আরে দেশে থাকলেতো মায়ের + বউয়ের হাতের রান্না তো খেতে পারতাম ,শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে পারতাম , একুল ঐ কুল সবই হারালাম পেলাম শুধু আঘাত তবুও থেমে  থাকিনি চলছি জীবন যুদ্ধ করে বার বার হোঁচট খেয়েছি তাইতো কারো কাছে আজ আমি ভালো নই এটাই প্রবাসীদের বাস্তব জীবন ......


মুছা গাজী 

সিঙ্গাপুর প্রবাসী৷

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.