ADS

বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি


বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ


বাংলাদেশ বর্তমানে যেভাবে উন্নয়নের গতিপথে দৌঁড়াচ্ছে তা দেখে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ’(সিইবিআর)-এর ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১’ নামের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সন নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।১৯৩টি দেশের মধ্যে এখন প্রথম অবস্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে সাত বছর পরই চীন হয়ে যাবে প্রথম এবং নয় বছর পর জাপানকে হটিয়ে ভারত হবে তৃতীয়।ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থানও এগুবে।দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চীন যেখানে স্বল্প সময়ে করোনার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে সেখানে অনিয়ন্ত্রিত করোনার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।সিইবিআরের রিপোর্টের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১-২৫ সনের মধ্যে বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬.৮ শতাংশ অর্জিত হবে।২০২০ সনে ৪১তম অবস্থান থেকে অনেকটা লাফ দিয়ে বাংলাদেশ উঠে যাবে ২৫তম অবস্থানে।তবে করোনার নতুন সংস্করণের আঘাতে বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতি পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে পূর্বাভাসে উল্লেখিত বাংলাদেশের অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।


মহামারী করোনার আঘাতে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যুদস্ত।করোনার কারণে প্রতিটি দেশে উৎপাদন কমেছে, চাহিদা কমেছে, সরবরাহও কমেছে।করোনার কারণে কোন্ দেশ কতটুকু উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়েছে তা দ্বারা আগামী দিনগুলোতে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান নিরূপিত হবে।অর্থনৈতিক সামর্থ বিবেচনায় চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বর শক্তিতে পরিণত হওয়ার সংবাদ আগেই জানা গিয়েছিলো, কিন্তু করোনা-ভাইরাস মহামারির কারণে পূর্বে প্রদত্ত পূর্বাভাসের ৫ বছর আগেই চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।কারণ চীন করোনা ভাইরাস দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এনে অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি রোধ করতে সক্ষম হয়েছে।অন্যদিকে চীন থেকে বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার পর এই ভাইরাস বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে উলটপালট করে দিয়েছে, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।বিশ্বের বেশীরভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি মাইনাসে পৌঁছে গেছে।করোনা ভাইরাসের নতুন সংস্করণ ইউরোপ-আমেরিকাকে পুনরায় আঁকড়ে ধরেছে।ভ্যাকসিনের গণহারে প্রয়োগ শুরু হওয়ায় হয়তো অচিরেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমে যাবে, কিন্তু উৎপাদনের যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণে ব্যয়িত সময়ের মধ্যেই কিছু দেশ তাদের ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠে যাবে।


বিগত দশ বছর যাবত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়পড়তা ৬ শতাংশের বেশী ছিলো; করোনার পূর্ববর্তী ২০১৮- ২০১৯ অর্থ বছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.২ শতাংশ।চীনের মতো করোনা-কৌশল অবলম্বন না করেও বাংলাদেশ মন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে, এমন কী প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধরে রাখতেও সক্ষম হয়েছে।এতদসত্বেও আমাদের দেশজ উৎপাদন কমেছে, বিশ্বজুড়ে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় অব্যবহিত পূর্ববর্তী বছরের ৮.২% প্রবৃদ্ধি থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৮%।তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েও বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে প্রথম এবং বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।তবে এই হিসাব শুধু জিডিপি’র ভিত্তিতে; যে সকল দেশকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে টপকিয়েছে বা টপকাবে সেই সকল দেশের মাথাপিছু আয় অনেক বেশী এবং অর্থনীতির আকারও অনেক বড়। এশিয়া মহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, সৌদি আরব, জাপানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ‘মাইনাস’।বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে, করোনায় নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবীরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়নি, হলেও কেউ টের পায়নি।করোনায়  আক্রান্ত জনগণের ভয়-ভীতির মধ্যে গার্মেন্টস শিল্প চালু রাখার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে।


‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অভিধায় কলঙ্কিত বাংলাদেশের এই অভাবিত সাফল্যের গূঢ় রহস্য অনুসন্ধানেও অর্থনীতিবিদেরা গলদঘর্ম।লণ্ডনের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’ বর্তমান সরকারের কড়া সমালোচক, কিন্তু এই সাময়িকীটিও তার  ‘আউট অব দ্য বাস্কেট’ নিবন্ধে স্বীকার করেছে যে, দেশের উন্নয়নে করণীয় নিরুপনে বাংলাদেশ মডেলে পরিণত হয়েছে।দারিদ্র, মঙ্গা আর দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের এমন উন্নয়ন নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মিডিয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসায় পন্চমুখ।নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানকে সুইডেনের মডেলে উন্নীত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে টিভি’র টকশোতে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট জাইঘাম খান বলেন, সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে আগামী দশ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্তরে নিয়ে যেতে পারলেই পাকিস্তানের জনগণ খুশীতে আত্মহারা হবে।অন্যদিকে যে সকল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা, বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে সেই সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নয়নের স্বীকৃতি রয়েছে।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদী বড় বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে।বাংলাদেশ পদ্মা নদীর উপর ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেলসেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করার দু:সাহস দেখিয়েছে, মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করেছে, নিজস্ব প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনায় সমুদ্রগামী জাহাজ প্রস্তুত ও রপ্তানি করছে; এছাড়াও দেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ৩.৪৩ কিলোমিটারের কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা মেট্রোরেলসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।চাষযোগ্য জমির স্বল্পতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনের পরও তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না; দেশের লোকসংখ্যা কম হলে হয়তো এই অর্জন টেকসই হতে পারতো।তবে দারিদ্র্যসীমা হ্রাস পেয়েছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন ও রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পেয়েছে।উপরন্তু মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানো, জন্মহার স্থিতিশীল রাখা, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামে শৌচাগার নির্মাণ, পল্লী এলাকায় স্বাস্থ্য সুবিধার সম্প্রসারণ এবং শিশুদের টিকাদান কর্মসূচীর বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদদের চমকে দেয়ার মতো সফলতা অর্জন করেছে।পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের যে অভূতপূর্ব অর্জন তাতে নিয়োজিত সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী।ওষুধশিল্পে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।ডিজিটাল সেবার সম্প্রসারণ হয়েছে ব্যাপক।হতদরিদ্র বয়স্ক ব্যক্তি, সহায়-সম্বলহীন বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত দুঃস্থ মহিলা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের জন্য যে ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে তা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।


দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় যে সকল দেশকে ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সেই সকল দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে অনেক বেশী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ কম, আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশী; এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অহর্নিশ আঘাতে এখানে প্রায়ই নাজুক অবস্থার উদ্ভব হয়।এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির মহামারি। এখন ধর্মীয় উগ্রবাদ আর সামাজিক রক্ষণশীল মনোভাব পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সমৃদ্ধির গতি থেমে যেতে পারে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিবন্ধক ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উগ্রবাদ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।


লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী 

পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ahmedzeauddin0@gmail.com

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.