প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে ঠগবাজ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছে মর্মে সম্প্রতি হাইকোর্ট মন্তব্য করেছে।তপশীলি ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধানের আইনগত অভিভাবক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইন দ্বারা আরোপিত দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জালিয়াতি, দুর্নীতি, অর্থ তছরূপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।দায়িত্বে অবহেলার কারণে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরী বলেও হাইকোর্ট মন্তব্য করেছে।বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা বিআইএফসি থেকে কী পরিমাণ টাকা নিয়েছে তা নির্ধারণের জন্য একটি স্বতন্ত্র নিরীক্ষক কোম্পানি নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে একটি বিদেশি অংশীদারী প্রতিষ্ঠানের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে উল্লেখিত পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাই কোর্ট। আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ সঠিক বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ উল্লেখ করেছেন।
রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে নামে-বেনামে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও কর্তৃত্ব পেয়েছিলেন।তবে কাগজে-কলমে বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন প্রশান্ত কুমার বা পি কে হালদারের মা, ভাই, বান্ধবী এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন।এমন হয়েছে যে, তাদের এক প্রতিষ্ঠানের যা দায়, অন্য প্রতিষ্ঠানের তা-ই সম্পদ; তাদেরই এক কোম্পানি ক্রেতা, আরেক কোম্পানি বিক্রেতা।এরমধ্যে পিপলস লিজিং এখন বিলুপ্তির পথে, বাকি কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।কোন কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গুর অবস্থার সুযোগে পাকিস্তানি আমলের মতো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা আস্তে আস্তে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সম্পদশালী লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমদের মতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি থাকলে একজন ব্যক্তি এতগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারতেন না।
পি কে হালদারের মা, ভাই, বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন, তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তার নিজের ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গেছে।এই সকল অস্বাভাবিক জমা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করার কথা, এইসব অস্বাভাবিক লেনদেন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা।তবে আদালত উল্লেখিত দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তর নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে যে কথাটি উল্লেখ করেছে তা সুষ্ঠু আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায়।আদালতের অভিমত অনুযায়ী পিপলস লিজিং আর বিআইএফসি-এর মালিকানা পরিবর্তনে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।মালিকানা পরিবর্তনে যদি প্রতিষ্ঠান দুটির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটতো বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সহায়ক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না।মালিকানা হস্তান্তর অবশ্যাম্ভাবী করে তুলতেও নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে কাজ করেছে।মালিকানা হস্তান্তরের পর প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে পি কে হালদার নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।পিপলস লিজিং-এর পরিচালক পর্ষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা না থাকলে তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলো বলে জানা যায়।পর্যবেক্ষক যদি সত্য ঘটনা রিপোর্ট করে থাকে এবং উর্ধতন কর্তৃপক্ষ যদি রিপোর্ট মোতাবেক ব্যবস্থা নেয় তাহলে পি কে হালদারের এত অপরাধ করার সুযোগ পাওয়ার কথা নয়।তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত পরিদর্শন হয়ে থাকে।ক্যাসিনো ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে দুদক প্রথম পি কে হালদারের কিছু অপরাধ জানতে পারে।প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু দুদক জানার আগে তো বাংলাদেশ ব্যাংকের জানার কথা।
বিগত কয়েক বছর যাবত বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাত।বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের পাল্লা ভারী হলেও ব্যাংকিং জগতের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।হলমার্ক, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারী ব্যাংকিং জগতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা।সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর সাম্প্রতিককালের পি কে হালদারের তিন হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং জগতে ভাবমূর্তির ধস নেমেছে।এসব অনিয়ম রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে না।শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্রয়ে এক সময়ের ‘শক্তিশালী’ বেসিক ব্যাংকটির নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো।বেসিক ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের ক্ষমতা সম্পর্কে সৃষ্ট ইমেজের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন এই ব্যাংকের অনিয়মের স্তুপ নিয়ে চুপচাপ ছিলো, ঘাটাতে সাহস করেনি।সবাই জানতো যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের নিয়োগে কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক ও এই চেয়ারম্যানের আশীর্বাদ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ নষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের পর থেকে।তখন থেকেই ডেপুটি গভর্নর হওয়ার জন্য প্রার্থীদের অনেকে ব্যবসায়ীদের কাছে ধর্ণা দিতে শুরু করে। বার্ষিক গোপনীয় রিপোর্টের ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়ে সচিব, সিনিয়র সচিব হতে পারলে নিচু পদ মর্যাদার ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয়। স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন কর্পোরেশনে নির্বাহী প্রধান নিয়োগেও সার্চ কমিটি নেই; এমন কি গুরুত্বপূর্ণ পদ গভর্নর নিয়োগেও সার্চ কমিটি নেই।বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ তলানিতে নামে তখন যখন সবাই বলাবলি করতে থাকে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব বন্টনেও নাকি প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা হস্তক্ষেপ করে থাকেন; কারণ তাদের নথি বিশেষ পদ্ধতিতে চিহ্নিতপূর্বক উপস্থাপন করা হয়।হয়তো এসব কথা অতিরন্জিত ও অসত্য।কিন্তু ইমেজ নষ্ট হলে অসত্যও সত্য রূপে জনতা গ্রহণ করে।
আর্থিক অপরাধের বিচার না হওয়ায় সবাই অনিয়মে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, সংক্রামক ব্যাধির মতো এই অনিয়ম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশায় অর্থনৈতিক দুর্বৃত্ত এবং অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়, পুষে রাখে- আদালতের এমন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।দুদক থেকে একবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ উঠলে জবাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন।সব প্রতিষ্ঠানই নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে,পরিস্কার-পরিশুদ্ধ ভাবে।ডিপোজিটরদের অর্থ আত্মসাতে ঠগবাজ ব্যবসায়ী ও প্রতারকরা যাতে উর্ধতন কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় না পায় সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে পরিশেষে বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নরের নিকট আদালত প্রত্যাশা করেছে।সরকারের কোন সেক্টরে যখন স্বাভাবিক ম্যাকানিজমে কাজ করে না, দৃশ্যমান অনিয়মে সবাই অভ্যস্ত হতে হতে নিয়মাচার প্রতিষ্ঠায় কারো মাথা ব্যথা থাকে না তখন বোধ হয় আদালত থেকে অনিয়ম আর অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর আরও বেশী সংশ্লিষ্টতা ও সক্রিয়তা আশা করে।
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন।
ahmedzeauddin0@gmail.com

