একজন মুক্তিযোদ্ধার 'মুক্তিযোদ্ধা ভাতা' পেতে অশেষ বিড়ম্বনার কাহিনী:
আমার খালা। আপন খালা। পঞ্চাশোর্ধ বয়স। নয়-দশ দিন আগে আমাকে ফোন করে বললেন, 25 থেকে 30 হাজার টাকা ধার দিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টাকা দিয়ে কি করবে? খালা বললেন, তোমার খালুর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার জন্য এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হবে। আমি খালার কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। কিন্তু খালা বিস্তারিত বলতে পারলেন না। বললাম খালুকে দাও। খালু (মানিকগঞ্জ) ফোনটা হাতে নিয়ে সব বললেন। তিনি বললেন, "আমি 1971 সালে যুদ্ধ করেছি। ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরিতে যোগদান করি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে। 2005 সালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হই। কিন্তু আমি জানতাম না ।জানতে পারি 2015 সালে। জানার পর সমস্ত কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করি। গত তিন- চার বছরে এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। এবার ত্রিশে জানুয়ারির মধ্যে আবার আবেদন দিতে হবে এবং বাছাই হবে। এজন্য এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হবে। এখন দিতে হবে 60 হাজার আর কাজ হয়ে যাওয়ার পরে দিতে হবে 40 হাজার।"
খালুর এসব কথা শোনার পর আমি বললাম, "এসব কাজে তো ঘুষ লাগে ন। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আপনি যেনতেন মুক্তিযোদ্ধা নন ।আপনি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগদান করেছেন। কৃতিত্বের সাথে সেনাবাহিনীর চাকরি শেষ করেছেন ।আপনি অনেক বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা। সে যাই হোক এসব কাজের ঘুষ দিতে হয়না।ঘুষ দেয়ার প্রয়োজন নেই। কাগজপত্রগুলো আমাকে দিন আমি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে দিব। এমনিতেই হয়ে যাবে। কোন ঘুষ লাগবেনা । ঘুষ ছাড়া যদি হয় সেটা কি আপনি চান না ?" খালু বললেন," হ্যাঁ অবশ্যই চাই ।আমিতো এক লক্ষ টাকা ধারদেনা করে জোগাড় করছি।"
এসব কথা বলার পর আমি খালুকে বললাম, আমি শুক্রবার বাড়ি আসছি। আপনি কাগজপত্রগুলো আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। খালু বললেন, ঠিক আছে। আমিই আসবো। আমার খালু সব কাগজপত্র নিয়ে আসলেন শুক্রবারে। আমি সমস্ত কাগজপত্র দেখলাম। দেখলাম তিনি অর্থাৎ আমার খালু 1971 সালে দুই নম্বর সেক্টরে এইচএম কামরুজ্জামান এর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন । মুক্তিযোদ্ধা সনদ এবং সকল কাগজপত্র দেখলাম। এইচএম কামরুজ্জামান এর স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেট দেখে আমার বুকটা কেমন হু হু হু করে উঠলো। সব কাগজপত্র দেখে এত কষ্ট পেলাম- আমার খালু একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যিনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন এবং সেই যুদ্ধের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগদান করেন ।সেই ব্যক্তি 2005 সালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও তিনি এখন পর্যন্ত ভাতা পাননি। সকল কাগজপত্র দেখে আমার দুই চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছিল। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এই কাজের জন্য। তিনি এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছেন কাজ হয়নি। এখন আবার এক লক্ষ টাকা ধার দেনা করে দিচ্ছেন কাজ হওয়ার জন্য।
খালুকে বললাম, খালু সব কাগজপত্র আমি নিয়ে যাচ্ছি। আমি আগামীকাল মন্ত্রণালয়ে জমা দিব। কাউকে ঘুষ দিবেন না। খালু বললেন,"না- না -না ঘুষ না দিলে কাজ হবে না। আমি চার-পাঁচ বছর ধরে খুব পেরেশানি হচ্ছি। সে আমাকে কথা দিয়েছে এক লক্ষ টাকা দিলেই কাজ হয়ে যাবে এবার। সে আমার কাগজপত্র নিয়ে গেছে। তাকে দিতে হবে ।যদি না দেই তাহলে আমি আর ভাতা পাব না। এই বলে আমার খালু কেঁদে দিলেন ।দুই চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি ঝরছিল।"
আমি খালুকে জিজ্ঞেস করলাম, যে ব্যক্তি আপনার কাছে এক লক্ষ টাকা চাইলো সে কে? খালু বললেন, তার নাম মাসুদ। বাড়ি কৈট্টা (মানিকগঞ্জ)। রাজিবপুর একটা স্কুল হয়েছে সেখানে শিক্ষকতা করে,মাটির কন্ট্রাক্টর কাজ করে, ভেকু গাড়ি আছে ,আরো ব্যবসা-বাণিজ্য আছে।"
সেই কাগজপত্র আমার আর আনা হয়নি । বিষয়টি আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। খুব কষ্ট লাগছে। আরো যে কত মুক্তিযোদ্ধা এভাবে নাজেহাল হচ্ছেন তা কে জানে.... হে আল্লাহ সকল নিপীড়িত নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষদের সহায় হোন।
ফরিদা ইয়াসমিন
মিনিষ্ট্রি অফ এডুকেশন বাংলাদেশ

