ADS

ধর্মনিরপেক্ষতার দেশে সাকিবের ক্ষমা প্রার্থনা



ধর্মনিরপেক্ষতার দেশে সাকিবের ক্ষমা প্রার্থনা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ


বাংলাদেশের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান কলকাতায় কালীপুজার একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন; এই উপস্থিত থাকা নিয়ে অনেকে তার প্রতি ক্ষেপে উঠেছিলেন।সাকিবের কথা অনুযায়ী তার পুজার স্থলে যাওয়ার পূর্বেই এক সন্ন্যাসী পুজার উদ্বোধন করেন; সাকিব আলাদা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।এতদসত্বেও সাকিবকে উদ্বোধন করার অভিযোগে দায়ী করা হয়েছে।দাওয়াত কার্ডে অবশ্য উদ্বোধক হিসাবে নয়, অতিথি হিসাবে সাকিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হতে কখনো শুনিনি।এছাড়াও ভিন্ন ধর্মের লোক উদ্বোধন করলে পুজা গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়।পুজাটির মূল উদ্যোক্তা বিধায়ক পরেশ পালের জন্মভূমি বাংলাদেশ, তাই তিনি ক্রিকেট জগতের খ্যাতিমান তারকা বাংলাদেশের সাকিবকে তাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছিলেন।তবে সাকিব একটি প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন; একা নয় অনেকের সাথে।এই অনেকের মধ্যে ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, কলকাতায় বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রদূতসহ আরও কয়েকজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী।বিধায়ক পরেশ পালের নির্বাচনী এলাকায় মুসলমানেরা পরেশ বাবুকে পছন্দ করেন, ভোট দেন; সাকিবকে নিজের পাশে রেখে ভবিষ্যতে মুসলমানদের ভোট নিশ্চিত করতে পরেশ বাবুর এটি একটি প্রচেষ্টাও হতে পারে।আমোদজনক বিষয় হচ্ছে, মুসলমান বা অন্য ধর্মের লোক গেলে তাদের পুজামণ্ডপ এখন আর আগের মতো অপবিত্র হয় না, অথচ এক সময় মুসলমানের হাতের ছোঁয়ায় অপবিত্রতার অজুহাত তুলে কত মাটির কলস ভেঙ্গেছে তারা।


মহসিন তালুকদার নামে সিলেটের এক যুবক ফেসবুকে লাইভ ভিডিওতে এসে রামদা দেখিয়ে সাকিবকে অশ্লীল গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘সবাই হুনিয়া রাখইন আমি মহসিন তালুকদার কইরাম, সাকিবরে ফাইলে আমি কোপাইয়া কাটিমু।’ মহসিন তালুকদার শুধু হত্যার হুমকি দিয়েই থামেননি, সাকিবকে তিনি ধর্মের ব্যাপারে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের অনুসরণেরও পরামর্শ দিয়েছেন।কিন্তু পরদিন সকালে আবার এই মহসিন তালুকদারই তার আগের দিনে উত্তেজিত হয়ে গালিগালাজ করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এক সময়ের শশ্রুমণ্ডিত হাজ্বী সাকিবকে পুজামণ্ডপে দেখে তার মাথা গরম হয়ে যায়, উত্তেজনায় সারারাত ঘুমাতে পারেননি, তার মনে হয়েছে সাকিব এ কাজ করতে পারেন না- সাকিবের পুজামণ্ডপে যাওয়ার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র রয়েছে।ষড়যন্ত্র যারই হোক না কেন, গরম মাথায় রামদার ঘুর্ণয়মান প্রদর্শনী তো সারা বিশ্বের লোক ইউটিউবে দেখতে পেয়েছে, সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে ক্ষুন্ন হলো তা পুনর্ভরণ হবে কী দিয়ে? এভাবে চলতে থাকলে পাশ্চাত্যের ইসলাম ভীতির ফোবিয়ায় বাংলাদেশও তালিকাভুক্ত হতে পারে।এই রামদা প্রদর্শনে চাকুরী প্রত্যাশী হাজার হাজার বাঙ্গালীর বিদেশ যাত্রা বিঘ্নিত হবে, যারা পাশ্চাত্যে নাগরিকত্ব লাভের আশায় দিন গুনছে তাদের নাগরিকত্ব লাভ বিলম্বিত হবে, যারা ভিটেমাটি বিক্রি করে কাজের সন্ধানে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন তাদের চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হবে।


সোশ্যাল মিডিয়াতে এসে সাকিব প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন।তিনি বলেছেন, 'গর্বিত’ মুসলমান হিসেবে কালীপুজার অনুষ্ঠানে যাওয়া তার উচিত হয়নি।এই বক্তব্য নিয়ে আবার পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য আসছে।তার ক্ষমা চাওয়াকে অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, আবার অনেকে উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তুলেছেন, অনেকের মতে সাকিব হত্যার ঝুঁকি এড়াতে মৃত্যু ভয়ে ভবিষ্যতে এমন কাজ আর না কারা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।ভয়ে হোক বা আত্মোপলব্ধি থেকে হোক, ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সাকিবের একান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অভিরুচি দ্বারা তাড়িত; কারো ভালো লাগা, মন্দ লাগার বিষয়টি এখানে অবান্তর।তবে পৃথিবীতে কিছু কিছু লোক আছেন যারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে সন্মানীয়।সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, আলবার্ট আইনস্টাইন, পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো- এদের জ্ঞানের আলো ও খেলার দ্যুতি মানবসমাজকে আন্দোলিত করে।ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই  মানুষগুলোর কাছে জাত, ধর্ম, বর্ণ মুখ্য নয়।শুধু ম্যারোডোনাকে ভালোবাসি বলেই আমরা আর্জেন্টিনার নাম জানি, নেইমারকে পছন্দ করি বলেই ব্রাজিলকে চিনি, মেসির যাদুকরী খেলা আমাদের মুগ্ধ করে বলেই তার দেশের পতাকা আমাদের ছাদে উড়ে।মানব সভ্যতার এই অগ্রগতিতে কোন বিশেষ ধর্মের লোকদের একক কৃতিত্ব নেই, যুগ যুগ ধরে অজস্র আবিস্কারের সুফল ভোগ করে আমরা জীবনকে আরামপ্রদ ও উপভোগ্য করে তুলেছি- ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর আবিস্কার বলে কেউ তা পরিত্যাগ করিনি।চিকিৎসা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি আমাদের গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে; অসুখ হলে ভিন্ন ধর্মের আবিস্কৃত ওষুধ ও চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করতেও কাউকে দেখা যায়নি।কলকাতার যে পুজোতে সাকিব গিয়েছিলেন সেখানে তিনি একজন মুসলিম হিসেবে নন, বরং একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটার হিসেবে গিয়েছিলেন।ক্রিকেটের জন্য সাকিব বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।কীর্তি ও কৃতিত্বের জন্য সাকিবকে অনেকেই নিজেদের লোক ভাবেন, গর্বিত মুসলমানের ঘোষণা থাকলে নিশ্চয়ই বিধায়ক পরেশ পাল তাকে বিপদে ফেলতেন না।


বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখতে দেখা যায়।বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে রাষ্ট্রীয়ভাবেও শুভেচ্ছা বানী দেয়া হয়; বঙ্গভবন, গণভবন আনন্দে মেতে উঠে।রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা আগের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যখন দুর্গাপুজাকে ‘সর্বজনীন’ বলে অভিহিত করেন তখন তা সর্বজনীনতার অভিধায় অভিষিক্ত হয়ে যায়।আগের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যখন বলেন, ‘দুর্গাপূজার অন্তর্নিহিত বাণীই হচ্ছে হিংসা, লোভ ও ক্রোধরূপী অসুরকে বিনাশ করে সমাজে স্বর্গীয় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ন্যায় ও সুবিচার নিশ্চিত হবে’ তখন আমরাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বর্গীয় শান্তি অনুভব করি।মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ধর্মের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন।কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো প্রায়ই রমজানের ইফতার, খ্রিস্টানদের সেইন্ট-জিয়ান-ব্যাপটিস্ট ডে, হিন্দুদের দিওয়ালী ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আনন্দ সহকারে যোগ দেন, তিনি নিহত মুসলমানদের দাফন অনুষ্ঠানে গিয়ে কোরআনুল কারিমের তিলাওয়াত শুনেন, আসসালামু আলাইকুম বলে মুসলমানদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।মসজিদে ট্রুডো অন্য একজন মুসলমানের সাথে প্রার্থনা করছেন এবং তার সাথে খাবার খাচ্ছেন এমন একটি ছবি প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লাসের সাথে প্রচার হতে থাকে যে, ট্রুডো খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।জাস্টিন ট্রুডোর ইসলাম প্রীতি দেখে আমাদের অনেকে উল্লাসে ফেটে পড়ি, আর পুজামণ্ডপে সাকিবের উপস্থিতি দেখে রামদা দেখিয়ে সাকিবকে কতলের হুমকি দিই।মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের হিন্দু সাহিত্যিগণ দেব-দেবীর স্তুতিমূলক সাহিত্য যেমন রচনা করেছেন, তেমনি হিন্দু শাসকদের সভাসদে বসে ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম গেয়ে লিখেছেন মুসলিম বিদগ্ধজন।হিন্দু ঢাকির কাঠির আঘাতে উত্থিত ঢাকের আওয়াজ শুনে আমরা বাল্যকালে বুঝতাম যে, ইদের মাঠ আমাদের ডাকছে।


সামাজিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, সামাজিক অগ্রগতি আমাদের জন্য অভিশাপ ডেকে আনছে, নতুবা ফেসবুকে লাইভে এসে প্রকাশ্যে রামদা উঁচিয়ে পৃথিবীর সেরা একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়কে এভাবে হুমকি দেয়া সম্ভব হতো না।ফেইসবুকের সংঘবদ্ধ অপপ্রচার ও আক্রমন দিন দিন সমাজের কিছু লোককে উত্তেজিত করে তুলছে।এই অস্বস্তিকর পরিবেশে সাকিবের মাফ চাওয়া সঠিক বলে মনে হয়, কারণ বর্তমান সমাজের হিংসাত্মক বাস্তবতা অস্বীকার করার ক্ষমতা একমাত্র পাগলদের রয়েছে।এখন এমন একটা ভয়ের আবহ বিরাজ করছে যে, ধর্ম নিয়ে স্বাভাবিক আলোচনাও করা যায় না।বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম ও মানুষের উৎপত্তি, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ইত্যাদি নিয়ে যে বিপরীতধর্মী একাডেমিক আলোচনা হয় তাও এক সময় বাদ দেয়ার প্রস্তাব আসতে পারে।বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায়ও যদি অনুভূতিতে আঘাত লাগে তবে তা হবে অন্ধকারকে শক্তি দিয়ে ঢেকে রাখার প্রয়াস।’এভাবে হত্যার হুমকি দিয়ে যদি শীর্ষ তারকার বক্তব্য আদায় করা যায়, তাহলে ক্ষমতার সিংহাসন উলটে দিতেও খুব বেশী দিন সময় লাগবে না!’


লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী 

পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ahmedzeauddin0@gmail.com

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.