ADS

উন্মত্ত জনতার উন্মাদনা _ জিয়াউদ্দীন আহমেদ



উন্মত্ত জনতার উন্মাদনা
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
কিছুটা ভারসাম্যহীন শহিদুন্নবী জুয়েল নামে একজন সাবেক স্কুল শিক্ষক তার বন্ধু সুলতান যোবায়েরসহ মোটর সাইকেলে করে রংপুর থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দর কেন্দ্রীয় মসজিদে গিয়ে আছরের নামাজ আদায় করেন।মসজিদের খাদেমের কথা অনুযায়ী নামাজ শেষে তারা নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে কোরআন শরীফের শেলফে অস্ত্র খুঁজতে থাকেন।আরেকটি বক্তব্য হচ্ছে, নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের তাকে রাখা কোরআন শরীফ নামাতে গিয়ে অসাবধনাতাবশত কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে পড়ে গেলে জুয়েল কোরআন তুলে তাকে চুম্বন করেন।এই দুটি কারণের কোনটিই এখনো নিশ্চিত হয়নি।জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটির প্রধান এবং স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য অনুযায়ী মসজিদে কোরআন অবমাননার কোন ঘটনা ঘটেনি। তবে কোন কারণে কয়েকজন মুসল্লি মসজিদের বারান্দায় শহিদুন্নবী ও তার বন্ধুকে মেরেছে।পরে স্থানীয় একজন মেম্বার তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখেন।তাদের দীর্ঘক্ষণ তালাবদ্ধ করে রাখার বিয়ষটিও সন্দেহজনক।মুখে মুখে, ফোন ও ফেইসবুকে দ্রুত প্রচার হয়ে যায় যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে ইউনিয়ন পরিষদে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।শত শত লোক জড় হয়ে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা জানালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা করে, যুবায়েরকে আহত করে।পরে জনতা জুয়েলের মরদেহ মহাসড়কে নিয়ে কাঠখড়ি ও পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
প্রায় একই সময়ে কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ম অবমাননার আরেকটি গুজব ছড়িয়ে তিনটি হিন্দু বাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।ফ্রান্স প্রবাসী এক ব্যক্তি ফ্রান্স থেকে ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘ফরাসি প্রেসিডেন্ট যে সব অমানবিক চিন্তাভাবনাকে শায়েস্তা করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়’ এবং তাতে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার স্কুল শিক্ষক শংকর দেবনাথ মন্তব্য করেছেন, ‘স্বাগতম প্রেসিডেন্টের উদ্যোগকে’।অন্য গ্রামের অনিল ভৌমিকও তা সমর্থন করেন।অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের গ্রেফতার করা হয়।কিন্তু বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে উন্মত্ত জনতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বনকুমার শিবের বাড়ীসহ ঐ দুইজনের বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে।ফ্রান্সে হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনে আমাদের দেশে মুসলমানের মধ্যে যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছিলো সেই ক্ষোভের উপশম হয়েছে একজন নামাজী মুসলমানের হত্যা আর হিন্দুদের বাড়ী-ঘরে আগুন লাগিয়ে।
পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের গ্রামেও এমন একটি ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি।আমাদের গ্রামের কাকা আবদুল গণি মুহুরী তার বাড়ীর পাশে একটি মসজিদ গড়ে তোলে নিয়মিত সেই মসজিদের খাদেমগিরি করতেন।তার ছেলে আমার ক্লাসমেট ছিলো বিধায় এই মসজিদে আমারও নামাজ পড়ার সুযোগ হয়েছিলো।তিনি ছিলেন ধার্মিক এবং নামাজী; তার সুন্নতি দাড়ি ছিলো, সব সময় পায়জামা-পান্জাবী-টুপি পরে লাঠি হাতে নিয়ে চলাফেরা করতেন।পুরাতন ও জীর্ণশীর্ণ একটি কোরআন শরীফের পাতা উড়ে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়তে দেখে তিনি সম্ভবত দুটি পাতা মসজিদের সামনে পুড়িয়ে দেন।এই পুড়িয়ে দেয়ার খবর প্রচারিত হলে মাদ্রাসায় পড়ুয়া একজন যুবক তাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে বাজারে যাওয়ার সময় তাকে ঢিল মারতে থাকে, এই অবস্থায় তিনি আমাদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন।এখানেই ঘটনার ইতি ঘটে।ঐ মাদ্রাসার ছাত্রের অপকর্ম তখন সমাজ গ্রহণ করেনি, তাকে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মারার কথা কেউ চিন্তাও করেনি।
উন্মত্ত জনতা দ্বারা পুড়িয়ে মারার কাহিনী সব ধর্ম ও ইতিহাসে আছে।খ্রীষ্টান বিশপ সিরিল বিজ্ঞানী হাইপেশিয়াকে ডাইনী আখ্যা দিয়ে খৃস্টান জনতাকে এতোটা উন্মত্ত করতে সমর্থ হয়েছিল যে, উন্মত্ত জনতা তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে আগুনের মাঝে ছুড়ে দিয়ে নরপিশাচের মতো উল্লাসে মেতে উঠেছিলো।পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এমন বিজ্ঞান সম্মত কথা বলার জন্য দুশো বছর আগে ইউরোপে ব্রুনোকে ধর্মান্ধরা পুড়িয়ে হত্যা করেছে।আফগানিস্তানে এই বছর মে মাসে কোরআন পোড়ানোর অভিযোগ দিয়ে ফারকুণ্ডা নামের সাতাশ বছরের এক মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।তাহলে দুশো বছর পূর্বের ব্রুনোর ইউরোপ আর দুশো বছর পরের শহিদুন্নবী জুয়েলের বাংলাদেশ এবং ফারকুণ্ডার আফগানিস্তানের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ইসলাম শান্তির ধর্ম; ধর্ম শান্তির হলেও আমরা কিছু অনুসারী ধর্ম বহির্ভূত অশান্তি করে যাচ্ছি।সুন্নি মাজহাবের বিখ্যাত ৬টি হাদিস গ্রন্থের মধ্যে একটি অন্যতম লেখক আল নাসায়ি (রহ.) তাঁর ৭৯ বছর বয়সে দামেস্কের প্রধান মসজিদের মিম্বরে মুয়াবিয়াপন্থীদের গণপিটুনিতে মারা যান।কারাগারে বন্দী প্রখ্যাত ইমাম আবু হানিফা(রহ.)-কে প্রতিদিন বাইরে এনে তৎকালীন মুসলমান শাসকের নির্দেশে প্রকাশ্যে দোররা মারা হতো।অথচ আবু হানিফা (রহ.) ৪০ বছর এশার নামাজের অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন।খোলাফায় রাশেদীনের চার জন খলিফার মধ্যে তিন জন মুসমানদের হাতে নিহত হলেও হযরত ওসমান(রা.)-কে হত্যা করে কিছু উন্মত্ত মুসলিম জনতা।পদত্যাগের দাবি অস্বীকার করায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শত শত মুসলমান তাঁকে দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ রেখে পরিশেষে কোরআন পাঠরত অবস্থায় অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে, রক্তমাখা সেই পবিত্র কোরআন এখনো সংরক্ষণে আছে।বিদ্রোহীদের ভয়ে টানা তিন দিন উসমান (রা)-এর লাশ বাসায় পড়ে ছিল।
শত শত হাজার হাজার বছর পার করেও মানুষ নামের জীবগুলো মানুষ হয়ে উঠতে পারলো না।ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসারে বানরের ক্রমবিকাশে মানুষের সষ্টি; তাই যদি হয় তাহলে মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ এখনো হয়নি, পশু থেকে মানুষ হতে আরও সময়ের প্রয়োজন।কিন্তু আমরা মুসলমানেরা ডারউইনের বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী নই, আমরা মানুষ হয়েই জন্ম নিয়েছি এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।তাহলে এখনো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বহু লোককে পিটিয়ে বা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় কেন?গুজব শুনেই আমরা উন্মাদ হয়ে যাই, বিবেক-বিচার-বুদ্ধি সব লুপ্ত হয়ে যায়।যারা জুয়েলকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করেছে তাদের সবাই নামাজ পড়ে কী না জানা নেই, কিন্তু নিহত জুয়েল নামাজ পড়তেন, তার শিশু সন্তানের মাথায়ও টুপি দেখা যায়।মরদেহের উপর আগুনের লেলিহান শিখা প্রদর্শন করে চতুর ধর্মান্ধরা জীবিতদের বুঝিয়ে দিলো যে- সাবধান, ধর্মের অবমাননা করলে এমন হয়।
আপোষ-মীমাংসা, মামলা এবং গ্রেফতারের পরও ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা অনভিপ্রেত।তাই যারা মেরেছে, যারা মরদেহ পুড়িয়ে উল্লাস করেছে, যারা বাড়ী-ঘরে আগুন দিয়েছে শুধু তাদের নয়, তাদের সাথে যারা এমন হত্যা ও অগ্নি সংযোগে বিভিন্নভাবে ইন্ধন যুগিয়েছে তাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন।গুজব রটিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অপপ্রচারের কারণে সমাজে কিছু উম্মাদ লোকের সৃষ্টি হয়েছে যাদের এমন উম্মাদনা অঙ্কুরে ধ্বংস করা জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য।কিন্তু করবে কে? বহু অঘটন ঘটার পর সরকার এতদিন পর বলছে যে, ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে সহিংস ঘটনার মাধ্যমে কোন কোন গোষ্ঠী দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে।সরকারের এতদিন পর এমন বোধোদয় আমাদের বিস্মিত করে।সাম্প্রতিককালে যে সকল অঘটন ঘটেছে সেগুলোর দৃশ্যমান কোন শাস্তি জনগণ দেখতে পায়নি; লোকদের ধারণা হয়েছে, জনতার নামে সংঘটিত কোন অপকর্মেরই শাস্তি হয় না।সরকারের তরফ থেকে অবশ্য প্রতিবারই বলা হয়, ‘অপরাধী যেই হোক তাকে ছাড়া হবে না’- এমন কথা শুনে মানুষ হাসে।
লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী
পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.