ADS

বৃহন্নলার চিঠি

"বৃহন্নলার চিঠি"
✍️ Dalia Das Roy

               মা, তুমি কেমন আছো মা? কোথায় আছো তুমি? জানো মা আজ প্রতিমুহূর্তে তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। বহুদিন পর আজ আবার অঝোরে কেঁদে চলেছি। আজকের দিনটার কথা তোমার মনে আছে মা? কেউ মনে রাখেনি কখনো। শুধু তুমি সবার অলক্ষ্যে একটু পায়েস দিয়ে যেতে আমায়। আজ যে আমি একুশে পড়লাম! তোমার মুখেই গল্প শুনেছি মা, আমি জন্মাবার পর সবাই তোমায় অপয়া-অলক্ষী বলেছিল। খুব শখ ছিল তোমার মেয়ের। দুই ছেলের পর মেয়ে হলাম ঠিকই,কিন্তু আমাকে তৈরি করার সময় ভগবানের অভিমানের ভাগটা এতটাই বেশি ছিল যে আমাকে তৃতীয় লিঙ্গ বানিয়ে দিল। সবাই তোমাকে বললো যে অনেক পাপ করলে নাকি এমন সন্তানের জন্ম হয়। কারোর কথায় কর্ণপাত না করে সবার লাঞ্ছনা-গঞ্জনা মুখ বুজে বুকে আগলে রাখতে তুমি আমায়। আদর করে নাম রেখেছিলে মিনি। বাবার আমার প্রতি একটু মায়া থাকলেও তার মা,পরিবারের চাপে আর সেটুকুও রাখা সম্ভব হয়নি। অবশেষে আমাকে নিয়ে তুমি বাড়ির এক কোণে ভালোবাসায় শিক্ষায় বড় করে তুললেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো সমাজ। আমার মত মেয়েরা নাকি মায়ের কোল নয়, হাতে তালি দিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক লড়াই করেও তুমি শেষ রক্ষা করতে পারলে না। আমি তখন বছর দশ, ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওরা আমাকে তোমার থেকে। আলু থালু চুলে খোলা আঁচল ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে চোখের জলে বুক ভিজিয়ে ছুটে গেলে তুমি, কিন্তু আটকাতে পারলে না। সেদিন আমি হয়ে উঠলাম মিনি থেকে মনিকা। তারপর সমাজ আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে দেয়নি। আমি যেখানে এসেছিলাম তার খানিক দূরের এক মন্দিরে আজকের দিনে সবার অলক্ষ্যে পায়েস দিয়ে পূজো দিয়ে যেতে তুমি। মন্দিরে জন্মদিনে পুজো দেওয়া কোন প্রসাদ বরাদ্দ ছিল আমাদের মত বৃহন্নলা দের। আর তাই তোমার বানানো পায়েস তোমার অজান্তেই পেতাম আমি। জানো মা দুই বছর আগে এক বাড়িতে বাচ্চা নাচাতে গিয়েছিলাম আমি। আমার অতি কাছের মানুষ রক্তের সম্পর্কের মানুষের বাড়ি। আমার দাদার বাড়িতে তারই ছেলেকে নাচাতে। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার তবুও আমি মুখ ফুটে কিছু বলিনি! আমি চিনলেও যদিও তারা চিনতে পারেনি আমায়! হয়তো মনেই নেই.,আর মনে রাখবেই বা কেন! তাদের মতো সভ্য সমাজে তো আমাদের কোন জায়গা নেই। তাদের ভাষায় আমরা হিজরে। আচ্ছা মা, আমাদের কি ভালোলাগা, ভালোবাসা, অনুভূতি কিছুই নেই!! আমাদের কি কষ্ট পেতে নেই মা!! হিজরে হয়ে জন্মানোতে আমাদের কি অপরাধ মা? তোমারই বা কি অপরাধ ছিল। তোমার দুই ছেলে থেকেও না থাকার মত। বাড়ির এক কোণে অবাঞ্চিতের মতো পড়ে থাকতে তুমি। যারা তোমাকে অপয়া-অলক্ষী বলতো তারা ফিরেও তাকাইনি তোমার দিকে। জানো মা,সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম যখন দূর থেকে দেখি তোমাকে চার পায়াতে করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কাছে যেতে পারিনি মা। তোমার মুখে মাথা রেখে হাঁউ-মাঁউ করে কাঁদতে পারিনি মা। পরিস্থিতি আমার হাত পা বেঁধে দিয়েছিল। মাগো,সামনের জন্মে আমি যেন মনিকা নয় তোমার সত্যিকারের মিনি হয়েই জন্মাই। আজ আমার জন্মদিনের পায়েসটা না হয় তোলা থাক, সামনের জন্মে প্রতি জন্মদিনে তোমার কোলে বসেই পায়েস খাব মা।

                 তুমি ভালো থেকো মা। অনেক ভালো থেকো। আমিও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি এই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ভালো থাকার।
                       ইতি 
                                তোমার 
                                             মিনি
সূত্র: https://www.facebook.com/groups/abrittipremi/permalink/6136386146457741/?mibextid=Nif5oz

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.